বয়কট ট্রেন্ড বলিউডে নতুন কিছু নয়। কখনও সাম্প্রদায়িকতা কখনও দেশভক্তি, নানান ইস্যুকে সামনে রেখে বয়কটের ডাক দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন বলিউড সিনেমা। সেই তালিকার সাম্প্রতিক সংযোজন আমির খানের ‘সিতারে জামিন পর’। নেপথ্যে ঠিক কী কারণ? আসুন শুনে নেওয়া যাক।
স্রোতের সঙ্গে ভেসে যাওয়ার পরামর্শ দেন অনেকেই। তাতে নাকি নির্ঝঞ্ঝাটভাবে বাঁচা যায়। সমাজের প্রসঙ্গে বললে, সবার সঙ্গে একমত হয়ে চলা। যারাই উলটোপথে হাঁটবেন, তাদেরই বিরোধিতা সহ্য করতে হতে হবে। বিষয়টাকে দোষ বলাই যায়। সোশ্যাল দোষ। সম্প্রতি যে দোষের ভাগীদার আমির খান। তাঁর নতুন সিনেমা ব্যানের নেপথ্যে এই সোশ্যাল দোষকেই দায়ী করা হচ্ছে।
বিষয়টা ঠিক কেমন?
বর্তমান সময়টা সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ। যে কোনও বিষয় নিয়েই সবথেকে বেশি আলোচনা হয় এই সোশ্যাল মিডিয়ায়। অভিনেতা থেকে দর্শক, বিচারক থেকে আসামী কিংবা শিক্ষক থেকে পড়ুয়া, সোশ্যাল মিডিয়ায় সকলের অবাধ বিচরণ। এক্ষেত্রেই মূলত একসুরে কথা বলার প্রসঙ্গটা সামনে আসে। যে কোনও বিষয় নিয়ে আলচনা হচ্ছে, তাতে যারা সমর্থন জানাবেন, সকলেই ভালো। কিংবা উলটোটা। তবে যা হবে সকলের ক্ষেত্রে এক হতে হবে। কখনও যদি ভুল করে বা মনের খেয়ালে সমর্থন জানাতে কেউ ভুলে যান, তাহলে বিষয়টাকে অসমর্থনের সমতুল্যই ধরা হবে। সেক্ষেত্রে যে ব্যক্তি এমনটা করবেন তাকে নাভাবে হেনস্থা করা হতে পারে। তিনি যদি পরিচিত মুখ হন তাহলে তো কথাই নেই। একেই সোশ্যাল দোষ বলা হচ্ছে। অর্থাৎ এমন কোনও ন্যারেটিভ যার সম্পর্কে গোটা সমাজ একরকম ভাবছে, কোনও একজন ভাবছেন উলটোটা, তিনিই দোষী। এর সঙ্গে আমিরের নাম জুড়ল কীভাবে?
তাতেও বর্তমান সময়টাকে তুলে আনতে হয়। বিগত কয়েক সপ্তাহ জুড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটিই বিষয় ট্রেন্ডিং, ভারত-পাক সংঘাত। ঘোষণা না হলেও দুই দেশের অশান্তি যে যুদ্ধ পরিস্থিতির সমতুল্য হয়েছে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। খোদ ভারতীয় সেনাপ্রধানের কথাতেও সে ইঙ্গিত মিলেছে। মোটের উপর সেই নিয়েই চর্চা চলছে। বারবার সামনে আসছে অপারেশন সিঁদুরের নাম। সেটাই অবশ্য স্বাভাবিক। সাধারণ মানুষ তো বটেই, সেলিব্রিটিরাও বিষয়টা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব হয়েছেন। অভিনেতা, গায়ক, ইনফ্লুয়েন্সর সবাই দেশের সেনাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন এই প্রসঙ্গে। কেউ কেউ ব্যক্তিগত মত জুড়ে বিষয়টাকে আরও আপন করে তুলে ধরেছেন। তার জন্য প্রশংসাও কুড়িয়েছেন। এই দলে আমির খানকে দেখা যায়নি। ভারত-পাক সংঘাত বা অপারেশন সিঁদুর, কোনও প্রসঙ্গেই সরাসরি মন্তব্য করতে শোনা যায়নি তাঁকে। সেই সময় আলাদা করে আমিরের নাম সামনেও আসেনি। মানে এতবড় সেলিব্রিটি হয়েও তিনি বিষয়টা নিয়ে কোনও মন্তব্য করলেন না, এই নিয়ে তেমন মাথা ঘামায়নি কেউ। ঘটনার দিন পাঁচেক পেরিয়ে যেতে হঠাৎ সামনে এল আমিরের নতুন সিনেমার পোস্টার। ঘটা করে তা সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করা হল আমিরের প্রযোজনা সংস্থার তরফে। এই পোস্টার দেখেই চটে লাল নেটদুনিয়া। সকলেই একযোগে বিরোধিতা করলেন। এই মর্মে যে, বর্তমান পরিস্থিতি তথাত পহেলগাঁও হামলা বা অপারেশন সিঁদুর নিয়ে কোনও কথা নেই, অথচ সিনেমার পোস্টার সামনে আনছেন আমির! উঠল সিনেমা বয়কটের দাবি। বিপদ বুঝে আমির সংস্থা আবার একটি পোস্ট করল। এবার অপারেশন সিঁদুর নিয়ে। বিষয়টি সম্পর্কে অন্যান্য সবাই যা বলছেন, খানিকটা সেই সুরেই। কিন্তু বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছে যে! তাই কটাক্ষের মাত্রা আরও তীব্র হল। অনেকেই ধরে নিলেন, স্রেফ সিনেমার স্বার্থে এমনটা করেছেন আমির বা তাঁর সংস্থা। তবে বয়কটের নেপথ্যে শুধুই কি এই একটা কারণ?
সেই হিসাবে দেখলে আরও অনেক চেনামুখ অপারেশন সিঁদুর বা ভারত-পাক সংঘাত নিয়ে কিছু বলেননি। তাঁদের কাউকে বয়কটের মুখে পড়তে হয়নি। একা আমির কেন এমন সমস্যায় পড়লেন? প্রাথমিক কারণ তো অবশ্যই সিনেমার পোস্টার রিলিজের পরে পরেই অপারেশন সিঁদুর নিয়ে পোস্ট করা। তবে এর বাইরেও বহু কারণ রয়েছে আমিরকে বয়কটের নেপথ্যে। সেগুলিও যে অভিনেতার সোশ্যাল দোষ, তা বলাই যায়। আসলে, আমির খান বিভিন্ন ইস্যুতেই সরব হন, এমন একটি চরিত্র। সেক্ষেত্রে ভারত-পাক সংঘাত নিয়ে তিনি সবার আগে কিছু বলবেন, এমনটা অনেকেই আশা করেছিলেন হয়তো। কিন্তু না, আমির এমনটা করেননি। যখন করেছেন তখন সিনেমার স্বার্থ জুড়ে ফেলেছেন। তাতে নেটিজেনদের রাগের কারনটা আরও স্পষ্ট হয়েছে। এখানেই শেষ নয়, সামনে এসেছে তুরস্কের সঙ্গে আমিরের সুসম্পর্কের কথা। বর্তমানে পাকিস্তানকে সমর্থনের জন্য তুরস্কের মতো দেশকে ব্যান করার ডাক উঠেছে ভারতে। সেখানে আমিরের তুরস্ক যোগ, অনেকের কাছেই দেশদ্রোহের সমান হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুরনো ভিডিও, ছবি, যেখানে আমিরকে সে দেশের প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে দেখা গিয়েছে, তা নিয়ে তুমুল চর্চা চলছে। আর সঙ্গে জুড়ছে, বয়কট ‘সিতারে জমিন পর’ এই হ্যাসটাগ।
আরও একটা বিষয় না বললেই নয়। আমিরের সিনেমা বয়কটের ডাক আগেও উঠেছে। পিকে থেকে শুরু করে লাল সিং চাড্ডা, বিভিন্ন সিনেমায় দেশবাসীর ভাবাবেগে আঘাতের অভিযোগ উঠেছে অভিনেতার বিরুদ্ধে। সেসব ক্ষেত্রে অবশ্য হিন্দুত্ববাদীদের দাবি ছিল। তাই মোটের উপর তেমন প্রভাব পড়েনি সিনেমার ব্যবসায়। কিন্তু এবার শুধুমাত্র হিন্দু সংগঠনের আপত্তি নয়, আরও অনেক সাধারণ দর্শকের আপত্তি জন্মেছে আমিরের আচরণে। কেউ কেউ বলছেন, এইভাবে সিনেমার প্রচার সারছেন আমির। যাকে নেগেটিভ পাবলিসিটি বলে। তবে বিষয়টা যে গুরুতর এমনটাও ধারণা বহু বিজ্ঞজনের। কিছু কিছু পোস্টে দেখা যাচ্ছে, আমিরের সামগ্রিক আচরণকে দেশদ্রোহের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। তা শুধুমাত্র অপারেশন সিঁদুর নিয়ে দেরিতে পোস্ট করা জন্য নয়। বরং অভিনেতার বলা কিছু কথা, যেখানে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী প্রকাশ পায় সেসবের জন্যও।
একটা সময়ের এত চর্চিত একজন অভিনেতার এমন পরিণতি অবাক করেছে অনেককেই। বিশেষত ফ্যানমহলে। অনেকেই হতাশ। সিনেমহলে আমিরকে মিস্টার পারফেকসনিস্ট বলা হয়। সেই অভিনেতা এমন ভুল কীকরে করলেন, কেনই বা করলেন, প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন ফ্যানরা। কিন্তু সব ভুলেও যদি সিনেমার দিক দিয়ে ভাবা হয়, তাহলেও একটা বিষয় বলতে হয়। ধরা নেওয়া যাক, আমির যথাসময়ে অপারেশন সিঁদুর নিয়ে পোস্ট করেছিলেন, ধরে নেওয়া যাক তাঁর তুরস্ক যোগ নেহাতই ‘ভুয়ো খবর’, তা সত্ত্বেও এই সিনেমা বয়কটের মুখে পড়তে পারে অন্য একটা কারণে। শোনা যাচ্ছে, সিনেমাটি নাকি হলিউড সিনেমা ‘চ্যাম্পিয়ন’-এর থেকে হুবহু টোকা। ট্রেলার দেখেই সাযুজ্য খুঁজে পেয়েছে নেটদুনিয়া। সেই প্রেক্ষিতেই ‘সিতারে জমিন পর’-এর বিরুদ্ধে গল্প চুরির অভিযোগে বিদ্ধ আমির খান। এর আগে ‘লাপাতা লেডিজ’ সিনেমার ক্ষেত্রে গল্পচুরির অভিযোগ উঠেছিল ‘মিস্টার পারফেকশনিস্ট’-এর বিরুদ্ধে। সুতরাং যাবতীয় বয়কট ট্রেন্ডের অন্যতম কারণ হিসেবে এই বিষয়টাকেও সামনে আনছেন অনেকেই।
- Bangla Podcast
- Bengali Podcast
- sangbad pratidin
- Sangbad pratidin shono